চেক ডিজঅনার মামলার নতুন নিয়ম ২০২৪

চেক ডিজঅনার হলে বাংলাদেশে প্রচলিত হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইন অনুসারে মামলা দায়ের, শাস্তি, জামিন ও আপিলের বিধান রয়েছে।

Advertisement
চেক ডিজঅনার মামলার নতুন নিয়ম

সাধারণত কোনো ব্যক্তিকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ এর চেক দেওয়ার পর ইস্যুকারী ব্যক্তির ব্যাংক একাউন্টে যদি সমপরিমাণ টাকা না থাকার কারণে বা চেক সম্পর্কিত অন্য যেকোনো ধরনের অসুবিধার কারণে যদি চেক গ্রহণকারী ব্যক্তি টাকা উত্তোলন করতে ব্যর্থ হয় তাহলে তা চেক ডিজঅনার হিসেবে গণ্য করা হয়।

চলুন তাহলে আজকে চেক ডিজঅনার মামলার নতুন নিয়ম, কি কি কারণে চেক ডিজঅনার হয়ে থাকে, চেক ডিজঅনার মামলার শাস্তি কি এ সকল বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করা যাক।

চেক ডিজঅনার কি

সাধারণত যখন একজন ব্যক্তি একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ লেনদেনের জন্য ইস্যু করা একটি চেক অন্য একজন ব্যক্তিকে দেয় এবং ইস্যু কারী ব্যক্তির ব্যাংক একাউন্টের যদি পর্যাপ্ত পরিমাণ টাকা না থাকে তাহলে ব্যাংক থেকে চেকটিকে অপরিশোধিত হিসেবে ফেরত দিয়ে দেয়া হয় এবং এই ঘটনাটিকেই চেক ডিজঅনার বলা হয়।

সহজ কথায় বলা যায় যে যখন একজন ব্যক্তি অন্য একজন ব্যক্তিকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকার চেক ইস্যু করে দেয় এবং ইসুকারী ব্যক্তির একাউন্টে পর্যাপ্ত পরিমাণ ব্যালেন্স না থাকে তখন সে চেকটিকে অপরিশোধিত বলে গণ্য করা হয় এবং এটিই হলো চেক ডিজঅনার।

চেক ইস্যু কারী ব্যক্তির একাউন্টে পর্যাপ্ত পরিমাণ টাকা না থাকলে চেক গ্রহণকারী ব্যক্তি ব্যাংক থেকে কোনো ভাবেই টাকা উত্তোলন করতে পারে না এবং ব্যাংক থেকে চেকটিকে অপরিশোধিত বলে ফেরত দিয়ে দেয়া হয়  এবং এর ফলে অনেক সময় চেক গ্রহণকারী ব্যক্তি বিভিন্ন অসুবিধার সম্মুখীন হয়।

চেক ডিজঅনার মামলার নতুন নিয়ম

চেক ডিজঅনার মামলার নতুন নিয়ম হচ্ছে চেক ইস্যুকারি এবং চেক গ্রহীতার মধ্যে লেনদেন সম্পর্কিত কোন চুক্তিপত্র না থাকলে চেক ইস্যুকারীর কোন শাস্তি হবে না। অর্থাৎ চেক ডিজঅনার হলেই সাজা নয় এবং চেক গ্রহণকারী আদৌ অর্থ ফেরত পাবে কিনা তার কোন নিশ্চয়তা থাকবে না।

Advertisement

বাংলাদেশের হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী চেক ডিজঅনার মামলার পূর্ববর্তী নিয়ম কিছুটা পরিবর্তন করে একটি নতুন নিয়ম করা হয়েছে। যার তথ্য সুত্র নিচে লিংক দেয়া হয়েছে।

সাধারণত চেক ডিজঅনার মামলার পূর্ববর্তী নিয়ম অনুযায়ী মামলা হওয়ার সাথে সাথে চেক ইস্যুকারী ব্যক্তিকে সাজা বা  শাস্তি দেয়া হতো কিন্তু এখন এই নিয়মে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে।

মামলা দায়ের করার পর যদি চেক গ্রহণকারী ব্যক্তি ইস্যুকারী ব্যক্তির কাছ থেকে চেক নেওয়ার বা চুক্তিবদ্ধ হওয়ার কোনো প্রমাণপত্র পেশ করতে পারে তবেই কেবল মাত্র চেক ইস্যুকারী ব্যক্তিকে শাস্তির আওতায় আনা হবে।

সুতরাং চেক ডিজাঅনার মামলার নতুন নিয়ম এটি যে চেক গ্রহীতা যদি লেনদেনের কোন বৈধ প্রমাণ দেখাতে না পারে তাহলে চেক ইসুকারী বা চেক প্রদানকারীর কোন ধরনের সাজা বা শাস্তি হবে না।

Advertisement

চেক ডিজাঅনার মামলার এই নতুন নিয়ম করার একটি মূল উদ্দেশ্য হলো যেকোনো ধরনের লেনদেন করার আগে যাতে দুই পক্ষের মধ্যে লেনদেনের বৈধতা বজায় রাখার জন্য বৈধ কোনো প্রমাণ বা চুক্তিপত্র তৈরি করা হয় এবং সকলে নিরাপদ লেনদেন করতে পারে।

চেক ডিজঅনার মামলা করার নিয়ম

চেক ডিজঅনার মামলা করার জন্য নিচের ধাপগুলো অনুসরণ করতে হবে।

১. চেক ডিজঅনার করার জন্য ব্যাংকে জমা দিন

প্রথমে, চেকটি ব্যাংকে জমা দিতে হবে। চেক জমা দেওয়ার সময়, “চেক ডিজঅনারের জন্য উপস্থাপিত” লিখে স্বাক্ষর করে রাখতে হবে। ব্যাংক চেক ডিজঅনারের কারণ উল্লেখ করে একটি “চেক ডিজঅনার সার্টিফিকেট” প্রদান করবে।

২. চেক প্রদানকারীকে লিগ্যাল নোটিশ প্রেরণ করুন

চেক ডিজঅনার সার্টিফিকেট হাতে পাওয়ার পর দ্রুততম সময়ে চেক প্রদানকারীকে লিখিত নোটিশ প্রেরণ করতে হবে। নোটিশটি রেজিস্ট্রি ডাকযোগে অথবা সরাসরি হাতে হাতে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে। নোটিশে নিম্নলিখিত বিষয়গুলি উল্লেখ করতে হবে:

Advertisement
  • নোটিশ প্রেরণকারীর নাম ও ঠিকানা
  • চেকের প্রদানকারীর নাম ও ঠিকানা
  • চেকের নম্বর, তারিখ ও টাকার পরিমাণ
  • চেক ডিজঅনারের কারণ
  • নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে টাকা পরিশোধ করার দাবি

৩. আদালতে মামলা দায়ের করুন

নোটিশ প্রেরণের পরও নোটিশে উল্লেখিত সময়ের মধ্যে টাকা বা ঋণ পরিশোধ না করা হয়, সেক্ষেত্রে আপনি আদালতে মামলা দায়ের করতে পারবেন। মনে রাখবেন, চেক ডিজঅনার মামলা দায়েরের সময়সীমা হলো চেক ডিজঅনারের তারিখ থেকে ৬ মাস।

মামলার পর আদালত শুনানির তারিখ নির্ধারণ করবে। শুনানির দিন উভয় পক্ষের আইনজীবী আদালতে উপস্থিত হয়ে যুক্তি উপস্থাপন করবেন। আদালত যুক্তি শুনে রায় প্রদান করবেন।

চেক ডিজঅনার মামলা করার জন্য নিম্নলিখিত কাগজপত্র প্রয়োজন হবে:

  • মামলা দায়েরের আবেদনপত্র
  • চেক ডিজঅনার সার্টিফিকেট
  • নোটিশের কপি
  • প্রয়োজনীয় অন্যান্য কাগজপত্র

আরও পড়ুন:

কি কি কারণে চেক ডিজঅনার হয়

চেক ডিজঅনার হওয়ার অনেকগুলো কারণ থাকতে পারে। চেক ডিজঅনার হওয়ার কারণগুলো হলো:

  • চেকে উল্লেখিত টাকার পরিমান ইসুকৃত ব্যক্তির ব্যাংকের ব্যালেন্সের থেকে বেশি হলে অর্থাৎ উল্লেখিত পরিমাণ টাকা ব্যাংকে না থাকলে চেক ডিসঅনার হয়;
  • চেক লেখার ক্ষেত্রে কোনো ভুল থাকলে চেক ডিজঅনার হয়;
  • চেকে করা স্বাক্ষর যদি ব্যাংকে সংরক্ষিত নমুনা স্বাক্ষরের সাথে না মিলে তাহলে চেক ডিজঅনার হয়;
  • চেকে লেখায় স্পষ্ট না হলে বা ঘষামাজা থাকলে চেক ডিজঅনার হয়;
  • চেকে উল্লেখিত অংকে লেখা টাকার পরিমানের সাথে কথায় লেখা টাকার পরিমাণের মিল না থাকলে চেক ডিজঅনার হয়;
  • চেকের মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পর ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলন করতে গেলে চেক ডিজঅনার হিসেবে বিবেচনা করা হয়;
  • চেকের উপর লেখার সময় কাটাকাটি হলে সেখানে উপরে সম্পূর্ণ স্বাক্ষর দিয়ে সত্যকরন করতে হয় আর তা না করলে চেক ডিজঅনার হয়;
  • দুর্ঘটনাবশত চেক ভিজে গেলে তা গ্রহণযোগ্য হয় না এক্ষেত্রে চেক ডিজঅনার হয়।

মূলত উপরোক্ত কারণ গুলোর জন্যই চেক ডিজঅনার হয়ে থাকে তবে এছাড়াও চেক ডিজঅনার হওয়ার আরো নানা ধরনের কারণ রয়েছে যার কারণে মামলা হলে শাস্তিযোগ্য অপরাধ পাওয়ার সম্ভবনা অনেক।

ব্যাংক চেক ডিজঅনার হলে করণীয় কি?

চেক ডিজঅনার হলে, ব্যাংক থেকে চেক ডিজঅনার সার্টিফিকেট সংগ্রহ করতে হয়। এরপর ১৫ দিনের মধ্যে চেক প্রদানকারীকে চেক ডিজঅনার হওয়ার বিষয়টি জানিয়ে চেকে উল্লিখিত অংকের টাকা পরিশোধের দাবি জানাতে হয়। নোটিশ পাওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে টাকা পরিশোধ করতে হয়। অন্যথায় তার বিরুদ্ধে মামলা করা যাবে।

নোটিশটি একজন উকিলের মাধ্যমে লিগ্যাল নোটিশ আকারে রেজিস্টার্ড ডাকযোগে পাঠাতে হবে। পাশাপাশি যে কোন জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশ করা যায়।

চেক ডিজঅনার মামলার শাস্তি

নির্দিষ্ট পরিমাণ লেনদেনের উদ্দেশ্যে কোনো ব্যক্তিকে যদি একটি চেক দেওয়া হয় এবং চেক ইস্যুকারী ব্যক্তির ব্যাংক অ্যাকাউন্টে যদি চেকে উল্লেখিত টাকার সমপরিমাণ টাকা না থাকে অথবা চেকে কোনো ধরনের সমস্যা থাকার কারণে যদি চেক গ্রহণকারী ব্যক্তি টাকা উত্তোলন করতে না পারে তাহলে তা চেক ডিজঅনার হিসেবে ধরা হয়।

বড় ধরনের লেনদেনের ক্ষেত্রে দেখা যায় চেক ডিজঅনার এর কারণে টাকা উত্তোলন করতে না পারার কারণে ভুক্তভোগী ব্যক্তি চেক ইস্যুকারী ব্যক্তির বিরুদ্ধে চেক ডিজঅনার এর মামলা করে থাকে।

কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে চেক ডিজঅনার এর মামলা করার পর সকল ধরনের বৈধ প্রমাণ দায়ের করা হলে এন আই এক্ট এর ১৩৮ ধারা মোতাবেক চেক ডিজঅনার মামলার সাব্যস্ত দোষীকে কমপক্ষে ১ বছরের কারাদন্ডে দণ্ডিত করা হবে।

চেক ডিজঅনার মামলার শাস্তি হিসেবে ন্যূনতম ১ বছরের কারাদণ্ড বা ইস্যুকৃত চেকে উল্লেখিত টাকার পরিমানের ৩ গুণ অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করা হবে; আবার অনেক ক্ষেত্রে কারাদন্ড ও অর্থদন্ড উভয় শাস্তি একত্রে প্রদান করা হবে।

তবে চেক ডিজঅনার মামলার নতুন নিয়ম অনুযায়ী মামলা করার পর অবশ্যই বাদীকে সঠিক ও বৈধ প্রমাণপত্র জমা দিতে হবে অন্যথায় এই মামলা গ্রহণযোগ্য হবে না এবং চেক ইস্যুকৃত ব্যক্তির কোনো শাস্তি হবে না।

চেক ডিজঅনার মামলার আপিল

চেক ডিজঅনার মামলার ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতে আপিল করা যায় নিম্ন আদালতের রায়ের ৩০ দিনের মধ্যে। তবে হাইকোর্টে আপিলের ক্ষেত্রে দায়রা জজ আদালতের রায়ের ৬০ দিনের মধ্যে আপিল করা যায়।

চেক ডিজঅনার মামলার আপিল করতে সাধারণত যেসব কাগজপত্র লাগে সেগুলো হলো:

  • আপিল আবেদনপত্র;
  • নিম্ন আদালতের চেক ডিজঅনার মামলার রায়ের কপি;
  • জরিমানা টাকার অর্ধেক পরিমাণের ব্যাংক চালান;
  • আপিলকারীর জাতীয় পরিচয়পত্রের নকল;
  • আইনজীবীর ভিসিটিং কার্ড ও ক্ষমতাপত্র (যদি আইনজীবীর মাধ্যমে আপিল করা হয়)
  • অন্যান্য কাগজপত্র (প্রযোজ্য হলে)

শেষ কথা

সবশেষে বলা যায় যে, চেক ডিজঅনার একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ আর তাই আমাদের উচিত প্রতারণার উদ্দেশ্য না রেখে কাউকে চেক প্রদান করার আগে নিজস্ব ব্যাংক একাউন্ট এর ব্যালেন্স সম্পর্কে অবগত হওয়া এবং চেক ডিজঅনার হয় এমন সকল কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকা।

তবে অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, যেকোনো ধরনের লেনদেনের ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে যাতে কোনো ধরনের অসুবিধা না হয় সেজন্য একটি বৈধ চুক্তিপত্র বা প্রমাণপত্র তৈরি করে রাখা উভয় পক্ষের জন্যই মঙ্গলজনক।

তথ্যসূত্র:

Advertisement

Similar Posts

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।