জমির রেকর্ড সংশোধন কিভাবে করা যায়

আপনার জমির রেকর্ডে কি ভুল রয়েছে? তাহলে জেনে নিন জমির রেকর্ড কিভাবে সংশোধন কিভাবে করা যায় তার বিস্তারিত প্রক্রিয়া।

Advertisement

জমির রেকর্ড ভুল সংক্রান্ত নানা জটিলতা দেখা যায় প্রতিনিয়তই, যেমন- জমির রেকর্ডে নামের ভূল, পিতার নামের ভূল, জমির পরিমানে ভূল, দাগ নাম্বারের ভূল ইত্যাদি। এছাড়া মালিক হওয়া সত্ত্বেও অন্য কারো নামে জমি রেকর্ড হওয়া কিংবা সরকারি রেকর্ডে নিজের জমি চলে যাওয়া এধরণের কিছু জটিলতা দেখা যায়।

এ সকল সমস্যার সমাধান করতে আপনাকে জানতে হবে কিভাবে জমির রেকর্ড সংশোধন করা যায়। তাই এ ব্লগে আলোচনা করলাম কিভাবে জমির রেকর্ড সংশোধন করার নিয়ম ও ধাপসমূহ নিয়ে। আশা করি আপনার কাজে লাগবে।

জমির রেকর্ড কি?

কোন জমির মালিকানা, জমির শ্রেনী, আয়তন ও মালিকানার অংশীদারদের সংখ্যা ও অবস্থা এবং কতটুকু জমি রয়েছে তার উপর ভিত্তি করে ভূমি মন্ত্রনালয়ের জরিপ অনুযায়ী একটি খসড়া ম্যাপ প্রনয়ন করা হয়। খসড়া ম্যাপে মালিকের নাম অনুযায়ী যে তালিকা করা হয় মূলত এটিই জমি বা ভুমি রেকর্ড। প্লটের পর প্লট আকারে ভূমি রেকর্ড তৈরি করা হয়, একে খানপুরিও বলা হয়। 

Advertisement

মৌজা ম্যাপই ভূমি রেকর্ডের মানচিত্র। সাধারনত ২০-৩০ বছর পর পর জমির রেকর্ডের জরিপ করা হয়।

আরও পড়ুন:

জমির রেকর্ড কত বছর পর পর হয়

সাধারণত সরকারিভাবে প্রতি ৩০ বছর পর পর সরকারি আমিন দ্বারা জমির রেকর্ড জরিপ করা হয়।

জমির রেকর্ড সংশোধন কিভাবে করা যায়

জমির রেকর্ড সংশোধন কিভাবে করা যায় তা নির্ভর করে রেকর্ড সংশোধনের বিষয়বস্তুর উপর। মালিকানা সংক্রান্ত জমির রেকর্ড সংশোধনের জন্য ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইবুনালে বা হাইকোর্টের আপিল বিভাগে মামলা দায়ের করে জমির রেকর্ড সংশোধন করা যায়। এছাড়া জমি রেকর্ডের করণিক ভুলের জন্য উপজেলা ভূমি অফিসে আবেদন করতে হয়।

Advertisement

অনলাইনে জমির খাজনা বা ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধন করতে দেখুন- অনলাইনে জমির খাজনা দেওয়ার নিয়ম

ভূমি মন্ত্রনালয়ের ‘আইন শাখা-০১’ এর সর্বশেষ ২০১৫ সালে প্রকাশিত ভূমি রেকর্ড সংশোধন আইন অনুযায়ী ৩ ধরনের কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে চূড়ান্ত জমির রেকর্ড বা খতিয়ানের ভুল সংশোধন করা যায়। যথা:

  1. সহকারি ভূমি কমিশনার
  2. ভূমি আপিল বোর্ড
  3. ল্যান্ড সার্ভে আপিল ট্রাইবুনাল অথবা সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ

১. সহকারী ভূমি কমিশনার বা AC Land অফিস

জমির রেকর্ডে করনিক ভূল হলে সহকারী ভূমি কমিশনার বা AC Land অফিসে আবেদন করে সংশোধন করা যায়। যেমন- নামের ভূল, অংশের পরিমান বসানোতে ভূল, দাগ নং অনুযায়ী ভূল, মানচিত্রের সঙ্গে রেকর্ডের ভূল, পিতা মৃত্যুবরন করলে সন্তানের নামে জমি রেকর্ড করার কথা থাকলেও সেক্ষেত্রে জরিপকারীদের ভূল লিপিবদ্ধ হয়ে বাবার নামেই রেকর্ড হলে ইত্যাদি সাধারন ভূল সংশ্লিষ্ট AC Land অফিস থেকে সংশোধন করা যায়।

অন্যদিকে চূড়ান্ত রেকর্ডে প্রতারনামূলক বা ইচ্ছাকৃত ভূল হলে প্রজাস্বত্বা বিধিমালা ১৯৫৫ এর বিধি ২৩ এর ৪ নং উপবিধি অনুযায়ী রেকর্ড সংশোধন করতে রাজস্ব কর্মকর্তার (বর্তমানে – সহকারী ভূমি কমিশনারের) সাহায্যে আবেদন করা যায়।

Advertisement

আরও পড়ুন- মৌজা কিভাবে বের করবো

২. ভূমি আপিল বোর্ড

Board of Land Administration এর মাধ্যমে খতিয়ানে প্রকাশিত সেটেলমেন্ট রেন্ট-রোলে ভূল লিপিবদ্ধ হলে তা সংশোধন করা যায়। ১৯৫০ সালের রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ এবং প্রজাস্বত্ব আইনের ১৪৯ ধারার ৪ নং উপধারা মতে Board of Land Administration কে এই ক্ষমতা দেওয়া হয়। কিন্তু বর্তমানে তা বিলুপ্ত হওয়ায় ভূমি আপিল বোর্ডের মাধ্যমে এ জাতীয় জমির রেকর্ড সংশোধন করা যায়।

৩. ল্যান্ড সার্ভে আপিল ট্রাইবুনাল অথবা সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ

জমির মালিকানা সংক্রান্ত দাবিতে জমির রেকর্ড ভুল হলে এবং ভোগদখল থাকা সত্বেও অন্য কেউ সেই জমির রেকর্ড মালিকানা দাবি করলে তা সাধারনভাবে সংশোধন করা যায় না। এর জন্য ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইবুনাল জমির রেকর্ড বিষয়ে যে কোন আদেশ প্রদান করতে পারে।

জমির রেকর্ড জরিপ করে চূড়ান্ত প্রকাশনার পর যে কোন ধরনের সংশোধনের আবেদন থাকলে তা- ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইবুনাল, ল্যান্ড সার্ভে আপিল ট্রাইবুনাল অথবা সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে বিচার করা হয়।

Advertisement

উপযুক্ত প্রমান দিয়ে ভূলের ধরন অনুসারে ৩ ভাবেই ভূল সংশোধনের জন্য জমির রেকর্ড সংশোধন মামলা বা আপিল করতে হয়। এক্ষেত্রে সঠিক তথ্য প্রদান করতে না পারলে কয়েকমাস থেকে কয়েক বছরও লাগতে পারে সংশোধনের জন্য। 

জমির রেকর্ডে করনিক ভুল সংশোধন করার নিয়ম 

উপজেলা ভূমি অফিস ও ইউনিয়ন ভূমি অফিসে জমির রেকর্ডে করনিক ভূল সংশোধন করে থাকেন। সহকারী ভূমি কমিশনার, ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা ও নামজারি সহকারীর মাধ্যমে এই সেবা পাওয়া যায়। জমির রেকর্ডের করণিক ভুল সংশোধন করার জন্য নিচের ধাপগুলো অনুসরন করুন।

ধাপ ১: AC Land অফিসে আবেদন

পূর্ববর্তী জরিপের কাগজপত্র, খাজনা বিবরনী, ইউনিয়ন ভূমি সহকারি কর্মকর্তার সাক্ষরিত খতিয়ানের কপি সহ AC Land অফিসে সহকারী ভূমি কমিশনারের কাছে আবেদন প্রনয়ণ করতে হবে।

ধাপ ২: ইউনিয়ন ভূমি অফিসে প্রতিবেদন 

AC Land এ আবেদনের পর আবেদনটি রেজিস্ট্রার করে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন ভূমি অফিসে প্রেরন করা হবে। ভূমি অফিসের সহকারী কর্মকর্তা সরজমিনে সেই আবেদনের তদন্ত ও রেকর্ডপত্র যাচাই করে একটি প্রস্তাব প্রতিবেদন তৈরি করবে এবং তা উপজেলা ভূমি অফিসে পাঠাবেন।

ধাপ ৩: সহকারী ভূমি কমিশনারের নোটিশ ও শুনানি

প্রতিবেদন প্রাপ্তির পর সহকারী ভূমি কমিশনার আবেদনকারীর জমির রেকর্ডকৃত মালিক এবং স্বার্থ সংশ্লিষ্টদের শুনানির তারিখ ও সময় নির্ধারন করে নোটিশ প্রদান করবেন। এবং নির্দিষ্ট দিনে শুনানি ও দলিলাদি যাচাই-বাছাই করার পর কোন বিরোধ না থাকলে সহকারী ভূমি কমিশনার রেকর্ড সংশোধনের আদেশ দেন।

ধাপ ৪: জমির রেকর্ড সংশোধন 

আদেশ প্রাপ্তির পর ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা প্রস্তুতকৃত সংশোধিত ৫ কপি খতিয়ানের স্বাক্ষরের জন্য আবেদনকারীর থেকে প্রয়োজনীয় ফি আদায় করেন। এবং খতিয়ানের-

  • ১ কপি মূল নথিতে
  • ১ কপি জেলা রেকর্ড রুমে
  • ১ কপি উপজেলা ভূমি সহকারী কর্মকর্তার নিকট
  • ১ কপি আবেদনকারীর নিকট
  • ১ কপি রেজিস্টারে সংরক্ষনের জন্য প্রেরন করা হবে।

ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা রেজিস্টার-২ হালনাগাদ করে পূনরায় প্রতিবেদন দাখিল করে এবং উর্ধতন প্রক্রিয়ায় এন্ট্রির মাধ্যমে জমির করনিক ভূল সংশোধন শেষ হয়।

জমির করনিক রেকর্ড সংশোধন হতে প্রায় ৩০-৪৫ দিন সময় লাগে এবং নির্দিষ্ট পরিমান ফি প্রদান করতে হয়। যেমন-

  1. কোর্ট ফি- ২০ টাকা
  2. জমির রেকর্ড সংশোধন ফি – ১০০০ টাকা
  3. প্রতি কপি খতিয়ানের জন্য ১০০ টাকা করে ফি প্রদান করতে হয়।

জমির রেকর্ড সংশোধন মামলা

জমির রেকর্ড সংশোধন মামলা করার জন্য

  • প্রয়োজনীয় সকল কাগজপত্র নিয়ে ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইবুনালে গিয়ে জমির রেকর্ড সংশোধনের জন্য সে বিষয়ে দক্ষ সিভিল এডভোকেট কে প্রয়োজনীয় খতিয়ান সংশোধানের দায়িত্ব দিতে হবে। 
  • তিনি ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনালে রেকর্ড সংশোধনীর জন্য একটি “ঘোষণামূলক” মোকদ্দমা করবেন। 
  • তারপর প্রয়োজনীয় প্রমানপত্র সাথে থাকলে সঠিকভাবে কার্য পরিচালনা করলে যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি খতিয়ান সংশোধন হয়।

জমির রেকর্ডে করনিক ভুল না হলে এবং জমির মালিকানা সংক্রান্ত সমস্যা দেখা দিলে কিংবা জমি সরকারি জমির রেকর্ডে এন্ট্রি হলে AC Land অফিস তা সংশোধন করতে পারেনা। এক্ষেত্রে ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইবুনালে জমির রেকর্ড সংশোধন মামলা দায়ের করতে হয়।

কয়েক মাস থেকে কয়েক বছর সময় লেগে যায় এ ধরনের রেকর্ড সংশোধন করতে। বর্তমানে হাইকোর্টে না গিয়েও ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইবুনালে মোকদ্দমা করা যায়।

জমির রেকর্ড সংশোধন করার প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস

জমির রেকর্ডে করনিক ভূল সংশোধন করতে ও মামলা করতে ক্ষেত্রবিশেষে নিম্নোক্ত কাগজপত্র গুলো প্রয়োজন হয়-

  • সর্বশেষ নামজারি খতিয়ানের সত্যায়িত কপি। যেমন- সি.এস, আর.এস, বি.এস এস.এ খতিয়ান।
  • মূল দলিলের সার্টিফাইড কপি।
  • আবেদনের স্বপক্ষের প্রমানপত্র। যেমন- ওয়ারিশ সনদপত্র।
  • আবেদনকারীর জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি।
  • আবেদনকারীর সদ্য তোলা এক কপি পাসপোর্ট সাইজের ছবি। 
  • সংশ্লিষ্ট মৌজার বিএস ও এসএ মৌজা ম্যাপ।
  • ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধের প্রমানপত্র
  • আদালতের রায়/আদেশ থাকলে তার সার্টিফাইড কপি।
  • বিএস জরিপের মাঠপর্চা এবং ডিপি খতিয়ান প্রয়োজন অনুসারে লাগতে পারে।
  • আবেদনকারীর পক্ষে স্বাক্ষী থাকলে তার জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি ও ছবি।

উপরোক্ত আলোচনা থেকে জমির রেকর্ড সংশোধন কিভাবে করা যায় তার সঠিক ধারনা নিয়ে প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস সংগ্রহ করে আবেদন করতে হবে।

FAQ’s

জমির রেকর্ড সংশোধন কিভাবে করা যায়?

সংশ্লিষ্ট ভূমি অফিসে বা AC Land অফিসে জমির রেকর্ডের করনিক ভূল সংশোধন করা যায় এবং মালিকানা সংক্রান্ত জটিল সমস্যার জন্য ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইবুনালে বা হাইকোর্টের আপিল বিভাগে মামলা দায়ের করে জমির রেকর্ড সংশোধন করা যায়।

জমির রেকর্ড জরিপ কত বছর পর পর করা হয়?

সরকারিভাবে প্রতি ৩০ বছর পর পর সরকারি আমিন দ্বারা জমির রেকর্ড জরিপ করা হয়।

আমার জমি অন্যের নামে রেকর্ড হলে কি করব?

জমি অন্যের নামে চূড়ান্ত রেকর্ড হয়ে গেলে রেকর্ডকৃত মালিক রেকর্ড ভূল স্বীকার করে মূল মালিককে না-দাবি দলিলের মাধ্যমে ফেরত দিতে হবে। স্বাভাবিকভাবে সম্ভব না হলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে।

জমির রেকর্ড সংশোধন করতে কত দিন লাগে?

জমির রেকর্ডের করনিক ভূল সংশোধন করতে ৩০-৪৫ দিন সময় লাগে। তবে অন্যান্য বিশেষ ভুলের ক্ষেত্রে কয়েক মাস থেকে কয়েক বছর সময় লাগতে পারে।

রেকর্ড সংশোধন করতে কত টাকা লাগে?

জমির রেকর্ডের করনিক ভূল সংশোধনের জন্য রের্কড সংশোধন ফি বাবদ ১০০০ টাকা লাগে। এছাড়া কোর্ট ফি- ২০ টাকা এবং প্রতি কপি খতিয়ানের জন্য ১০০ টাকা ফি পরিশোধ করতে হয়।

রেকর্ড সংশোধন মামলা কোথায় করতে হবে?

রেকর্ড সংশোধনের জন্য ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনালে / দেওয়ানী আদালতে একটি “ঘোষণা মূলক” মামলা করতে হবে।

জমি ভুলে অন্যের নামে রেকর্ড হলে কি করব?

জমি ভুলে বা অন্য যে কোনভাবে অন্যের নামে চূড়ান্ত রেকর্ড হয়ে গেলে রেকর্ডকৃত মালিক রেকর্ড ভূল স্বীকার করে মূল মালিককে না-দাবি দলিলের মাধ্যমে ফেরত দিতে হবে। এরুপ না-দাবি দলিল রেজিসিট্রকৃত হতে হবে অথবা হস্তান্তর দলিলের মাধ্যমে মালিককে ফেরত দিতে হবে

শেষকথা

জমির রেকর্ড সংশোধন কিভাবে করা যায় তা একটি জটিল বিষয়। তাই অবশ্যই পূর্বেই সঠিক ধারনা গ্রহন করুন ও পেশাদারদের পরামর্শ নিতে পারেন।

আজকের আলোচনায় জমির রেকর্ড সংশোধন কিভাবে করা যায় তা বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। লেখাটি সম্পর্কে কোন মতামত বা প্রশ্ন থাকলে কমেন্ট করে জানান। জমি ও সরকারি বিভিন্ন সেবা বিষয়ক এরকম তথ্য জানতে ভিজিট করুন আমাদের ওয়েবসাইট, ধন্যবাদ।

Advertisement

Similar Posts

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।