জমি ক্রয়ের পূর্বে ও পরে ক্রেতার করণীয়

জমি ক্রয়ের ক্ষেত্রে একজন ক্রেতার করনীয় কি হতে পারে তা আমাদের অনেকেরই অজানা। জানুন জমি ক্রয়ের পূর্বে ক্রেতার করণীয় কি কি এবং জমি ক্রয় করার পর করণীয় সম্পর্কে বিস্তারিত।

Advertisement

জমি ক্রয়-বিক্রয় আমাদের খুব পরিচিত একটি গুরুত্বপূর্ণ  বিষয়। জমি ক্রয়ের পূর্বে ক্রেতার অবশ্যই কিছু প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।

আজকের আলোচনায় আমরা জমি ক্রয়ের পূর্বে ক্রেতার করনীয় কি তা সম্পর্কে বিস্তারিত জানব।

জমি কেনার আগে কি কি দেখতে হয়

একটি নিরাপদ ও সন্তোষজনক জমি ক্রয় নিশ্চিত করতে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিবেচনা করতে হবে। বাংলাদেশে জমি কেনার আগে যে সকল বিষয় দেখতে হয় তা হলো:

  • জমির খতিয়ান ও মালিকানা বৈধ কিনা;
  • জমিতে কোন আইনি দায়বদ্ধতা, মামলা মোকদ্দমা ও সার্টিফিকেট মামলা আছে কিনা;
  • নির্ধারিত জমির আইনি কাগজপত্র;
  • আপনার ব্যবহারের উদ্দেশ্যের ক্ষেত্রে নির্ধারিত জমিটি সঠিক কিনা;
  • ভূমি পরিদর্শন করে ভূসংস্থান, মাটির গুণমান, নিষ্কাশন, ট্রান্সপোর্ট ইত্যাদি প্রয়োজনীয় বিষয় বিবেচনা;
  • বিদ্যুৎ, পানি সরবরাহ, পয়ঃনিষ্কাশন ইত্যাদি মোলিক ব্যবস্থা পর্যাপ্ত কিনা;
  • জমিটির নির্মাণের জন্য উপযুক্ত এবং প্রয়োজনীয় অনুমতি ও অনুমোদনপ্রাপ্ত কিনা;
  • জমির সাথে সম্পর্কিত যেকোন সম্ভাব্য পরিবেশগত ঝুঁকি বা উদ্বেগ আছে কিনা ;
  • জমির সঠিক জরিপ ও সীমানা;
  • জমিতে যাতায়াতের ব্যবস্থা আছে কিনা;
  • জমির স্থানীয় ও বাজার মূল্য বিশ্লেষণ;
  • জমিতে বিনিয়োগের যৌক্তিকতা।

যে কোন জায়গায় জমি ক্রয় করার আগে উপরোক্ত বিষয়গুলো বিবেচনা করে দেখা একান্ত জরুরী ও গুরুত্বপূর্ণ।

জমি ক্রয়ের পূর্বে ক্রেতার করণীয়

জমি কেনার আগে অবশ্যই আপনাকে নিম্মোক্ত বিষয়গুলো খেয়াল রাখতে হবে। বিশেষ করে বিক্রেতার মালিকানা এবং বিভিন্ন দলিল ভালোভাবে যাচাই বাছাই করে আইনগত কোন জটিলতা আছে কি না দেখতে হবে। জমির দলিলপত্র যাচাই না করে কোন জমিই কেনা উচিত নয়; নইলে বিপদে পড়তে পারেন, এমনকি প্রতারিতও হতে পারেন।

জমি ক্রয়ের পূর্বে ক্রেতার করণীয়

বাংলাদেশের জমি ক্রয়ের পূর্বে ক্রেতার যে সকল বিষয় বিবেচনা ও যাচাই করতে হয়, তা হলো:

Advertisement

১. জমির ধরণ

যে জমিটি ক্রয় করতে যাচ্ছেন, সেটি কি খাস জমি কিনা, পরিত্যক্ত/অর্পিত, অধিগ্রহণকৃত বা অধিগ্রহণের জন্য নোটিশকৃত কি না, তা উপজেলা ভূমি অফিস বা জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে জেনে নিতে হবে।

১. মালিকানা ও খতিয়ান যাচাই করা

জমির মালিকানা ও জমির তফসিল অর্থাৎ জমির মৌজা, খতিয়ান নম্বর, দাগ নম্বর এবং উক্ত দাগে জমির মোট পরিমাণ জেনে নিতে হবে। খতিয়ান অনুসন্ধান করে মালিকানার বিবরণ ও জমির রেকর্ড সনাক্ত করে নিশ্চিত করে নিতে হবে।

  • বিক্রেতা ক্রয়সূত্রে জমির মালিক হলে তার ক্রয় দলিল বা ভায়া দলিল রেকর্ডের সঙ্গে মিলিয়ে বিক্রেতার মালিকানা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে নিবেন।
  • বিক্রেতা উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত হলে সর্বশেষ জরিপের খতিয়ানে, বিক্রেতা বা তিনি যাঁর থেকে জমি পেয়েছেন তাঁর নাম এবং উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া জমির পরিমাণ মিলিয়ে দেখতে হবে। উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত জমি বিক্রেতার অন্যান্য শরিকদের সঙ্গে বিক্রেতার সম্পত্তি ভাগাভাগির বণ্টননামা দেখে নিতে হবে।

অনলাইনে জমির রেকর্ড ও মালিকানা যাচাই করে সহজেই জমির মালিকানা যাচাই করে নিতে পারেন।

২. পেশাদার আইনজীবীর পরামর্শ নেয়া

জমি ও সম্পত্তি বিষয়ক আইনে বিশেষজ্ঞ একজন যোগ্য আইনজীবীর সাহায্য নিতে হবে। আইনজীবীর সহযোগিতায় কাগজপত্র যাচাই করে আইনগত কোন সমস্যা আছে কিনা দেখতে হবে

Advertisement

একজন অভিজ্ঞ আইনজীবি আপনাকে জমি ক্রয়ের পুরো প্রক্রিয়া জুড়ে আইনগতভাবে সঠিক জমি ক্রয়ে সাহায্য করতে পারবে।

৩. ভূমি পরিদর্শন করুন

জমি ক্রয়ের পূর্বে তা নিজে সরেজমিনে পরিদর্শন করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিক্রেতার দেয়া তথ্য অনুযায়ী জমির অবস্থান, চৌহদ্দি ও মাপ নকশা অনুযায়ী ঠিক আছে কিনা দেখতে হবে। এছাড়া, আশে পাশের দখলদার থেকে খোঁজখবর নিয়ে তথ্য যাচাই করে দেখা উচিত।

মাটির গুণমান, টপোগ্রাফি, নিষ্কাশন ইত্যাদি সুবিধাগুলো নিজে পরিদর্শন করে জমি ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত।

৪. অবকাঠামো যাচাই করুন

জমির আশেপাশে মৌলিক অবকাঠামোগত সুবিধা যেমন পানি সরবরাহ, বিদ্যুৎ সরবরাহ, রাস্তা ইত্যাদি সুযোগ-সুবিধা পর্যবেক্ষণ করে নিতে হবে। জমিতে যাতায়াতের রাস্তা আছে কি না, তা–ও দেখা প্রয়োজন।

Advertisement

আপনি যে এলাকায় জমি কেনার পরিকল্পনা করছেন তার অবকাঠামো উন্নয়, বাজার চাহিদা এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পর্যবেক্ষণ করে নেয়া একান্ত জরুরী।

৫. জরিপ ও সীমানা যাচাই করুন

সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী জমির খতিয়ান অনুসন্ধান করে দেখতে হবে যে জমি রেকর্ড আছে কিনা। এছাড়া ম্যাপ ও চৌহদ্দি অনুসারে জমির সীমানা নির্ধারণ ঠিক আছে কিনা তাও খতিয়ে দেখতে হবে

জমির বিভিন্ন রেকর্ড এবং কাগজপত্র পর্যবেক্ষণ করে জরিপ ও সীমানা সঠিকভাবে যাচাই করার পরেই জমি কেনার সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত।

৬. দলিলসহ আইনি কাগজপত্র ও মামলা-মোকদ্দমা যাচাই করুন

জমি সংক্রান্ত সকল ধরনের আইনি কাগজপত্র যেমন বিক্রয় দলিল, নামজারি খতিয়ান, রেকর্ড অফ রাইটস ইত্যাদি চুক্তিগুলো পর্যবেক্ষণ করে নেয়া উচিত। কাগজপত্র নির্ভুল ও আইনগতভাবে সঠিক কিনা তা নিশ্চিত করে নিন।

বিক্রেতার কাছ থেকে সংগৃহীত দলিলের ফটোকপি, খতিয়ান ইত্যাদি কাগজপত্র সংশ্লিষ্ট ভূমি অফিসে গিয়ে তলবকারী /স্বত্বলিপি রেজিস্টারের সঙ্গে মিলিয়ে দেখুন সঠিক আছে কিনা।

পাশাপাশি, জমিটি নিয়ে কোন আইনি জটিলতা, বিরোধ, বন্ধক, বা দায়বদ্ধতা আছে কিনা অথবা জমিটি নিয়ে আদালতে কোন মামলা-মোকদ্দমা রয়েছে কিনা তা জেনে নিন। মামলাভুক্ত জমি কেনা উচিত নয়।

এছাড়া, জমিটি সার্টিফিকেট মোকদ্দমা ভুক্ত কি না, কখনো নিলাম হয়েছে কি না তা চেক করে নিতে হবে। মনে রাখবেন, সার্টিফিকেট মামলাভুক্ত সম্পত্তি বিক্রয়যোগ্য নয়।

৭. আর্থিক বিষয় ও বিনিয়োগের রিটার্ন বিবেচনা করুন

জমি ক্রয়ের পূর্বে আপনার আর্থিক সক্ষমতা, আনুসঙ্গিক খরচ, এবং জমিতে বিনিয়োগের উদ্দেশ্য ও সম্ভাবনা নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে। জমির মূল্য যৌক্তিক কিনা, অর্থ প্রদানের শর্তাবলী, রেজিস্ট্রেশন ফি, ট্যাক্স ইত্যাদি বিষয় ভেবে দেখুন। সব শেষে জমিতে বিনিয়োগ কেন করবেন।

ভূমি ক্রয়ের ক্ষেত্রে লোনের প্রয়োজন হলে লোন নেয়ার শর্তাবলী সম্পর্কে জেনে ও বুঝে নিতে হবে এবং আপনি লোন পরিশোধের বাধ্যবাধকতা পূরণ করতে পারবেন সেটিও নিশ্চিত করতে হবে।

৮. স্থানীয় কর্তৃপক্ষের পরামর্শ নিন

সংশ্লিষ্ট স্থানীয় কর্তৃপক্ষ যেমন পৌরসভা অফিস বা ভূমি প্রশাসন অফিসের কর্তৃপক্ষের সাথে পরামর্শ করে নেয়া উচিত। স্থানীয় কর্তৃপক্ষের থেকে উক্ত জমির সকল তথ্য সংগ্রহ করে নেওয়া উচিত।

আপনি যে এলাকায় জমি ক্রয় করতে চাচ্ছেন সেই এলাকায় স্থানীয় অভিজ্ঞদের জ্ঞান, পরামর্শ ও দক্ষতার ওপর ভিত্তি করে জমি ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।

বাংলাদেশের জমি ক্রয় করার আগে বা ক্রয় করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে উপরোক্ত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা অপরিহার্য।

জমি ক্রয় করার পর করণীয়

একটি জমি কেনার পরে মালিকানা হস্তান্তর ও বিনিয়োগ রক্ষার ক্ষেত্রে একজন ক্রেতার বেশ কিছু প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয়। জমি ক্রয় করার পর একজন ক্রেতার যে সকল প্রয়োজনীয় করণীয় রয়েছে তা নিচে দেয়া হল:

  • প্রথমত সরকারি ভূমি অফিসে গিয়ে জমি রেজিস্ট্রি করে মালিকানার আইনি স্বীকৃতি পাওয়া বা মালিকানা নিজের নামে হস্তান্তর করা;
  • এরপর স্থানীয় ভূমি অফিস থেকে মিউটেশন সার্টিফিকেটের জন্য আবেদন করতে হবে যা আপনার জমির মালিকানা অধিকার প্রাপ্তির  গুরুত্বপূর্ণ দলিল;
  • মালিকানা পরিবর্তনের পর ভূমি করের রেকর্ড আপডেট করতে হবে এবং ট্যাক্সের বাধ্যবাধকতার নিয়ম মেনে চলতে হবে;
  • আপনার জমির সীমানা স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করার জন্য প্রয়োজনে নাম লেখা সাইনবোর্ড বা বেড়া দিতে হবে;
  • প্রাকৃতিক দুর্যোগ, আগুন বা চুরির মত সম্ভাব্য ঝুঁকি থেকে আপনার বিনিয়োগ কে রক্ষা করতে বীমা প্রদানকারীদের সাথে পরামর্শ করে একটি সম্পত্তি বীমা করতে পারেন;
  • আপনার জমিটি যে উদ্দেশ্যে ব্যবহার করবেন তার একটি পূর্ব পরিকল্পনা তৈরি করে ফেলুন যাতে যেকোনো নির্মান বা উন্নয়ন সঠিকভাবে করা যায়;
  • বিভিন্ন প্রয়োজনীয় কাগজ পত্রের মাধ্যমে জমির পানি সরবরা,  বিদ্যুৎ সংযোগ ও পয়ঃনিষ্কাশন এর মতো প্রয়োজনীয় ইউটিলিটি ব্যবস্থা করতে হবে;
  • নিয়মিতভাবে জমি পরিদর্শন ও রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে যাতে কোন ক্ষয় বা লান্ডস্ক্যাপিং সমস্যা না হয় এবং জমির বাজার মূল্য ঠিক থাকে।

জমি ক্রয়ের পরবর্তী সময়ে এই গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গুলো গ্রহণ করতে হবে।

Advertisement

Similar Posts

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।