কাজী অফিসে ও কোর্টের মাধ্যমে তালাক দেওয়ার নিয়ম

অনেকেই আমরা তালাকের নিয়ম কানুন জানি না, চলুন জেনে নেই তালাকের ইসলামিক ও আইনগত প্রক্রিয়া কি এবং কোর্টের তালাক দেওয়ার নিয়ম ও শর্ত।

তালাক দেওয়ার নিয়ম
  • Save

ADVERTISEMENT

মানুষ স্বভাবতই সামাজিক জীব, এবং সামাজিক বন্ধনগুলোর ভিত্তি হলো সম্পর্কের নিবিড়তা। বিবাহ বন্ধন সেই সম্পর্কের মাধুর্যপূর্ণ রূপ, যা থেকে একটি সংসার গড়ে ওঠে। কিন্তু কখনো কখনো সংসারে নেমে আসে অশান্তি, যা বিবাহ বিচ্ছেদ বা তালাকের মতো কঠিন সিদ্ধান্তে গড়ায়।

অনেক সময় নিয়ম কানুন না জেনে তালাক প্রদান করলে আইনি জটিলতায় পড়তে হয়, এমনকি জেলও খাটতে হতে পারে। তাই তালাকের নিয়ম ও প্রক্রিয়া জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ADVERTISEMENT

চলুন বিস্তারিতভাবে জানি তালাক দেওয়ার নিয়ম এবং তালাক প্রক্রিয়ার সাথে সম্পর্কিত অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

তালাক কী?

তালাক হচ্ছে একটি আরবি শব্দ, যার অর্থ বিচ্ছিন্ন করা, ত্যাগ করা বা আলাদা করা। ইংরেজিতে এটি Divorce নামে পরিচিত। ইসলাম ধর্মে তালাক বলতে বিবাহ বন্ধনের আনুষ্ঠানিক বিচ্ছেদ বোঝায়।

ADVERTISEMENT

যখন স্বামী বা স্ত্রী পারস্পরিক মতের অমিল বা সমস্যার কারণে আর একসঙ্গে থাকতে চান না, তখন যে প্রক্রিয়ায় তারা বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন করেন, সেটাই তালাক।

তালাক মৃত্যুর মতো ভয়ংকর একটি বিষয়। মৃত্যু হলে যেমন ফিরানোর কোনো সুযোগ নেই। তালাক হয়ে গেলে এটি থেকে ফেরারও কোন সুযোগ নেই, নতুন করে বিয়ে করতে হবে।

তালাক হলো ইসলামী শরীয়তে অনুমোদিত হলেও অত্যন্ত অপছন্দনীয়। তাই তালাকের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে অবশ্যই ঠান্ডা মাথায় চিন্তাভাবনা করা জরুরি।

ADVERTISEMENT

তালাক বা বিবাহ বিচ্ছেদের ধরন

বিবাহ বিচ্ছেদের কয়েকটি ধরণ রয়েছে। এগুলো হলো:

  1. নোটিশের মাধ্যমে তালাক
  2. পারস্পরিক সম্মতিতে তালাক
  3. তালাক ছাড়া অন্য উপায়ে বিবাহ বিচ্ছেদ
  4. কোর্টের মাধ্যমে তালাক

১. নোটিশের মাধ্যমে তালাক (স্বামী কর্তৃক)

মুসলিম পরিবার আইন অধ্যাদেশ ১৯৬১ এর ধারা ৭ মতে, একজন পুরুষ তার স্ত্রীকে তালাক দিতে চাইলে, নোটিশের মাধ্যমে তালাক দেয়াকে একতরফা তালাকও বলা হয়। কারণ নোটিশের মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য অপর পক্ষের সম্মতি থাকার প্রয়োজন নাই।

দেখুন: নোটিশের মাধ্যমে তালাক দেয়ার নিয়ম

ADVERTISEMENT

২. তালাক ছাড়া অন্য উপায়ে বিবাহ বিচ্ছেদ (স্ত্রী কর্তৃক)

যদি বিয়ের কাবিন নামায় স্ত্রীকে যথাযথভাবে তালাকের অধিকার দেয়া হয় এবং স্ত্রী সে অধিকার প্রয়োগ করতে চায়, অথবা যদি স্বামী বা স্ত্রী তালাক ব্যতীত অন্য কোন উপায়ে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটাতে চায়, সেক্ষেত্রে তালাকের বিধানসমূহ যথাসম্ভব প্রয়োজনীয় পরিবর্তনসহ প্রযোজ্য হবে।

৩. পারস্পরিক সম্মতিতে তালাক

স্বামী-স্ত্রী তাদের পারস্পরিক সম্মতিতে তালাকের পদক্ষেপ নিতে পারেন। অথবা ২ পরিবারের সালিশি বৈঠকের মাধ্যমে দেনমোহর ও ভরণ-পোষণ পরিশোধ করে তালাক সম্পন্ন হয়। তবে কাজীর মাধ্যমে অবশ্যই তালাক রেজিস্ট্রেশন করতে হবে।

৪. কোর্টের মাধ্যমে তালাক (স্ত্রী কর্তৃক)

স্বামী তালাক দেয়ার জন্য আদালতে যেতে হয় না। তবে স্ত্রীকে যদি নিকাহনামার ১৮ নম্বর দফায় তালাকের অধিকার দেয়া না হয়, সেক্ষেত্রে স্ত্রী পরিবার আদালতে মামলা করে তালাকের আবেদন করতে হয়। তারপর, আদালত যাচাই-বাছাই করে আদেশ জারি করবে। আদালতের আদেশের ভিত্তিতে স্থানীয় প্রশাসন নোটিশ পাঠাবে, যা ৯০ দিন পর কার্যকর হবে।

দেখুন: কোর্টের মাধ্যমে তালাক দেওয়ার নিয়ম

তালাক দেওয়ার নিয়ম

মুসলিম পরিবার আইন অধ্যাদেশ ১৯৬১ অনুসারে, কোন পুরুষ তার স্ত্রীকে তালাক দিতে চাইলে স্থানীয় চেয়ারম্যানকে তালাক দিয়েছে মর্মে নোটিশ দিতে হবে এবং নোটিশের এক কপি তার স্ত্রীকে দিতে হবে। চেয়ারম্যানকে নোটিশ দেয়ার দিন থেকে ৯০ দিন পর তালাক কার্যকর হবে। পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশন হলে মেয়রকে এই নোটিশ দিতে হবে।

তালাক দেওয়ার নিয়ম
  • Save

Any man who wishes to divorce his wife shall, as soon as may be after the pronouncement of talaq in any form whatsoever, give the Chairman notice in writing of his having done so, and shall supply a copy thereof to the wife.

The Muslim Family Laws Ordinance, 1961. 7 (1)

বিবাহের কাবিন নামায় যদি স্ত্রীকে তালাকের ক্ষমতা দেয়া হয়, সেক্ষেত্রে স্ত্রী যুক্তিসংগত কারণে তালাক দেয়ার জন্য চেয়ারম্যানের কাছে আবেদন করতে পারে বা আইনের আশ্রয় নিতে পারে। আর যদি, স্ত্রীকে তালাকের ক্ষমতা দেয়া না হয়, সেক্ষেত্রে স্ত্রী বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটাতে চাইলে আদালতের শরনাপন্ন হয়ে মামলা করতে হবে।

আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ না করলে তালাক কার্যকর হয় না। তালাক দেয়ার নিয়ম ও শর্ত নিয়ে আরও বিস্তারিত নিচে আলোচনা করা হলো।

নোটিশের মাধ্যমে তালাক দেওয়ার নিয়ম

  • ধাপ ১: স্বামী যে কোন উপায়ে স্ত্রীকে তালাক দেয়ার পর, স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান অথবা পৌরসভা বা সিটি কর্পোরেশনের মেয়রকে লিখিতভাবে নোটিশ দিয়ে জানাবেন। স্ত্রীকেও একই নোটিশের কপি পাঠাতে হবে।
  • ধাপ ২: নোটিশ পাঠানোর দিন থেকে ৩০ দিনের মধ্যে, চেয়ারম্যান বা মেয়র ২ পক্ষের সমঝোতা বা মীমাংসার জন্য সালিসি পরিষদ গঠন করে সমাধানের চেষ্টা করবেন।
  • ধাপ ৩: সালিসি পরিষদ সমঝোতা করতে ব্যর্থ হলে, বা তালাক প্রদানকারী তালাক প্রত্যাহার না করলে নোটিশ প্রদানের ৯০ দিন পর তালাক কার্যকর হবে। এই ৯০ দিনের জন্য স্ত্রীর ভরণপোষণ দিতে স্বামী বাধ্য থাকবে।

নোটিশ প্রদানের পর ৯০ দিন বা ৩ মাস সময় অপেক্ষা করাকে ইদ্দত পালন বলা হয়। এই সময়ের মধ্যে যদি স্বামী-স্ত্রী পুনরায় মিলিত না হয়, তালাক কার্যকর হবে।

কোর্টের মাধ্যমে তালাক দেওয়ার নিয়ম

কোর্টের মাধ্যমে তালাক তখনই প্রযোজ্য যখন কাবিন নামায় স্ত্রীকে তালাক প্রদানের ক্ষমতা দেয়া না হয়। স্ত্রী আদালতের মাধ্যমে তালাকের আবেদন করবেন।

  • ধাপ ১: প্রথমে স্ত্রী একজন আইনজীবীর সাথে পরামর্শ করে পারিবারিক আদালতে তালাক পাওয়ার আবেদন করবেন।
  • ধাপ ২: আদালত আবেদন গ্রহণের পর স্বামীকে সমন জারি করে আদালতে হাজির হতে বলা হয়।
  • ধাপ ৩: যদি আদালত উভয় পক্ষের কথা শুনে ও তথ্য প্রমাণ যাচাই করে বিবাহ বিচ্ছেদের আদেশ দেয়, ৭ দিনের মধ্যে আদেশের সত্যায়িত কপি স্থানীয় চেয়ারম্যান বা মেয়রের কাছে পাঠানো হবে।
  • ধাপ ৪: চেয়ারম্যান বা মেয়র যেদিন নোটিশ পাবেন, সেদিন থেকে ঠিক ৯০ দিনের জন্য ইদ্দতকালীন সময়ের পর তালাক চূড়ান্তভাবে কার্যকর হবে।
  • ধাপ ৫: তালাক কার্যকর হলে, আদালতের আদেশের কপি স্থানীয় কাজী অফিসে জমা দিয়ে তালাক নিবন্ধন করতে হবে।

কি কি কারণে কোর্টের মাধ্যমে তালাক হয়

আদালত বা কোর্টের মাধ্যমে স্ত্রী তালাক দিতে চাইলে, এর জন্য অবশ্যই নিম্মোক্ত সুনির্দিষ্ট এক বা একাধিক কারণ থাকতে হবে। যেমন:

  • স্বামী চার বছরের বেশি সময় নিরুদ্দেশ থাকলে;
  • দুই বছর ধরে স্বামী ভরণপোষণ দিতে ব্যর্থ হলে;
  • মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ ১৯৬১ এর বিধান লঙ্ঘন করে স্ত্রীর অনুমতি ব্যতীত বিয়ে করলে;
  • স্বামীর নিষ্ঠুরতা, মানসিক বা শারীরিক অক্ষমতা থাকলে ইত্যাদি।

স্ত্রীর গর্ভকালীণ অবস্থায় তালাক

তালাক দেয়ার সময় স্ত্রী গর্ভবতী হয়ে থাকলে সন্তান জন্মের সময় ও ৯০ দিন যেটি পরে শেষ হবে, তার আগে তালাক কার্যকর হবে না।

অর্থাৎ যদি ৯০ দিনের আগেই সন্তান প্রসব হয়ে থাকে, তাহলে ৯০ দিন পরেই তালাক কার্যকর হবে, আর ৯০ দিন পার হওয়ার পরও সন্তান প্রসব না হওয়া পর্যন্ত তালাক কার্যকর হবে না। এই পুরো সময় অর্থাৎ ইদ্দতকালীণ সময়ে স্ত্রীকে ভরণ-পোষনের দ্বায়িত্ব স্বামীকে নিতে হবে।

তালাক পরবর্তী পদক্ষেপসমূহ

তালাকের পরে উভয় পক্ষের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ রয়েছে:

  • তালাক রেজিস্ট্রেশন: যে কোন উপায়েই তালাক দেয়া হোক না কেন, তালাক কার্যকর হলে অবশ্যই সেই কাজীর মাধ্যমে তালাক নিবন্ধন করতে হবে। কাজী সাহেব স্ত্রীর দেনমোহর সহ যাবতীয় পাওনা নিশ্চিত করার পর তালাক নিবন্ধন করবেন।
  • মোহরানা পরিশোধ: স্ত্রীর পাওনা মোহরানা প্রদান করতে হয়। স্ত্রীর মোহরানা পরিশোধে বাকি থাকলে অবশিষ্ট টাকা স্বামীকে পরিশোধ করতে হবে। অথবা, আদালতের আদেশ অনুযায়ী এটি নিশ্চিত করতে হয়।
  • স্ত্রীর সম্পত্তি ভাগ: আদালতের মাধ্যমে যৌথ সম্পত্তি ভাগাভাগি করা যায়। আদালত এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত প্রদান করতে পারে।
  • সন্তানদের প্রতিপালন: সন্তানের হেফাজত ও প্রতিপালনের বিষয়ে আদালত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সন্তানের সর্বোচ্চ স্বার্থ নিশ্চিত করতে হবে।

বিদেশ থেকে তালাক দেওয়ার নিয়ম

বিদেশ থেকে তালাক দেওয়ার জন্য দেশে অবস্থানরত কোন আত্মীয় বা পরিবারের সদস্যকে পাওয়ার অব এ্যাটর্নি দিতে হবে। তার তিনি স্ত্রী যে এলাকায় বসবাস করেন, সে এলাকার ইউপি চেয়ারম্যান বা পৌরসভার/ সিটি কর্পোরেশনের মেয়রকে তালাকদাতার পক্ষ থেকে তালাকের নোটিশ পাঠাবেন।

তবে, প্রথমে একজন আইনজীবির মাধ্যমে পাওয়ার অব এ্যাটর্নি বা ক্ষমতাপত্র এবং তালাকের নোটিশ তৈরি করে, তা বিদেশে পাঠিয়ে তালাক দাতার স্বাক্ষর নিতে হবে। ক্ষমতাপত্র ও তালাকনামায় অবশ্যই বিদেশী নোটিরি পাবলিক, বিচারক অথবা বাংলাদেশ দূতাবাসের বাণিজ্যদূত বা ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রতিনিধির সামনে স্বাক্ষর করতে হবে।

বিদেশ থেকে তালাক দেয়ার প্রক্রিয়া বিস্তারিত জানতে একজন আইনজীবির লেখা বিদেশ থেকে তালাক দেয়ার পদ্ধতি পড়তে পারেন।

FAQs

তালাক প্রদানের ইচ্ছায়, তালাকের ইংগিতবহ শব্দসমূহ যেমন, ডিভোর্স দিলাম, ছেড়ে দিলাম, তুমি আজাদ, তুমি মুক্ত, তুমি স্বাধীন ইত্যাদি শব্দ বললে তালাক হয়।

হ্যাঁ, ইসলামি দৃষ্টিকোন থেকে রাগের মাথায় তালাক দিলে তালাক হয়ে যাবে। তাই, রাগের মাথায় হোক বা দুষ্টুমির ছলে হোক এমন শব্দ উচ্চারণ করা উচিত নয়। দেখুন রাগান্বিত ব্যক্তির তালাক

শেষ কথা

তালাক ইসলাম ধর্মে একটি বৈধ কিন্তু অপছন্দনীয় কাজ। সংসারে সমস্যা হলে ধৈর্য ও সমঝোতার মাধ্যমে সমাধান খোঁজাই উত্তম। স্বামী-স্ত্রীর উভয়ের মধ্যে বোঝাপড়া ও ত্যাগ স্বীকারের মানসিকতা থাকলে সংসার মধুর হতে পারে। তাই তালাকের মতো কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে অবশ্যই বিষয়গুলো ভালোভাবে বিবেচনা করা উচিত।

তথ্যসূত্র:

  • মুসলিম পরিবার আইন অধ্যাদেশ ১৯৬১
  • মুসলিম বিবাহ ও তালাক রেজিস্ট্রেশন আইন ১৯৭৪

ADVERTISEMENT

Similar Posts

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।